বাতিল হচ্ছে পাসপোর্ট এর পুলিশ ভেরিফিকেশন

পুলিশ ভেরেফিকেশন মূলত একজন নাগরিকের চাকুরিসহ তার সামাজিক অবস্থান যাচাই করার একটি গুরুত্বপূর্ন প্রক্রিয়া। কিন্তু এই পুলিশ ভেরিফিকেশন এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে নাগরিককে করা হচ্ছে হয়রানি এবং সামান্যতম কারণেও অনেক সময় মোটা অংকের ঘুষ দিতে হচ্ছে এই Police Verification প্রক্রিয়ায়।

পুলিশ ভেরিফিকেশন কবে চালু হয় এবং কেন করা হয়?

১৯২০-এর দশকে ব্রিটিশ শাসনামলে পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রথা চালু হয়। চাকরি, পাসপোর্ট, লাইসেন্সসহ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে আবেদনকারীর তথ্য যাচাইয়ের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া ছিল। এর মাধ্যমে প্রার্থীর চারিত্রিক ও সামাজিক অবস্থানও যাচাই করা হতো। তখন এই প্রথার মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন দমন করা এবং চাকরিপ্রার্থীদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখা। কারণ, সেই সময় ব্রিটিশ কর্মকর্তারা ভারতবর্ষে নানা ধরনের গুপ্ত বা প্রকাশ্য হামলার শিকার হতেন।

ব্রিটিশরা তখন চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘পুলিশ ভেরিফিকেশন’ প্রথা চালু করেছিলেন, যাতে নিশ্চিত করা যায় যে প্রার্থীর কোনো ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক বিশ্বাস নেই। তবে, বর্তমানে এই প্রক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রেই বিরোধী মতাদর্শকে দমন, বৈষম্য সৃষ্টি এবং হয়রানির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিলের সুপারিশ

সম্প্রতি পুলিশ সংস্কার কমিশন ১৯ নভেম্বর ২০২৪ এক সুপারিশে জানিয়েছে যে, চাকরি ও পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে প্রার্থীর রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা যাচাই বন্ধ করা প্রয়োজন।

কমিশনের প্রধান বলেন যে, ভেরিফিকেশনের নামে হয়রানি ও দুর্নীতি বন্ধ করা অত্যন্ত জরুরি। প্রার্থীর বা তার পরিবারের রাজনৈতিক পরিচিতি যাচাই করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। আরও উল্লেখ করেছেন, বর্তমান ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া একটি বড় সমস্যায় পরিণত হয়েছে এবং এটি প্রার্থীদের জন্য চরম হয়রানির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

অনেকেই আবার পুলিশ ভেরিফিকেশন পদ্ধতির বিরুদ্ধে সমালোচনা করে ভেরিফিকেশন পুরোপুরি তুলে দেওয়ার প্রস্তাবকে অযৌক্তিক মনে করেছেন।

পুলিশ ভেরিফিকেশনে কোন কোন তথ্য যাচাই করা হয়

পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়ায় প্রার্থীর পরিচিতি ও আস্থার সঙ্গতি যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধরনের তথ্য যাচাই করা হয়। পুলিশ গোপনে বা প্রকাশ্যে প্রার্থীর উল্লিখিত ঠিকানায় সরজমিন তদন্ত করে থাকে। পুলিশ সূত্রের খবর, পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময় ২১টি বিষয় যাচাই করা হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো:

  • . প্রার্থী ও তার বাবার পুরো নাম, জাতীয়তা
  • ২. স্থায়ী ও অস্থায়ী ঠিকানা, বৈবাহিক অবস্থা
  • ৩. জন্ম তারিখ/জন্মস্থান, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পূর্বের চাকরি
  • ৪. প্রার্থী মুক্তিযোদ্ধার সন্তান/নাতি-নাতনি কি না, কোটাধারী কি না
  • ৫. প্রতিবন্ধী বা শারীরিক সমস্যা আছে কি না
  • ৬. নিকট আত্মীয়-স্বজনের বাংলাদেশ সরকারের কোনো সংস্থায় চাকুরির তথ্য

এছাড়া, প্রার্থীর পূর্ববর্তী অপরাধমূলক কার্যকলাপ, সাজাপ্রাপ্তি বা নৈতিক স্খলনের রেকর্ডও ভেরিফিকেশনে যাচাই করা হয়। প্রার্থী যদি কোনো সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত হন বা রাষ্ট্রদ্রোহী বা নাশকতামূলক কার্যকলাপে জড়িত থাকেন, তবে তা তদন্ত করা হয়। একইভাবে, কোনো মামলায় অভিযুক্ত, গ্রেফতার, দণ্ডিত অথবা নজরবন্দি থাকলে সেটিও যাচাই করা হয়।

এভাবে প্রার্থীর চারিত্রিক ও সামাজিক অবস্থান যাচাই করা হয়, যা ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়ার অন্যতম অংশ।

পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনে পুলিশের ঘুষ গ্রহণ

পাসপোর্টের জন্য ভেরিফিকেশন করতে গেলে পুলিশের কাছে পাঁচশ থেকে এক হাজার টাকা দেওয়ার একটি অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ কাগজে কলমে এ ধরনের টাকা দেওয়ার কোনো বিধান নেই।

আবেদনকারীর তথ্যের সচ্ছতা নিশ্চিত করতে পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া চলাকালে নানা ধরনের ভোগান্তি, পক্ষপাতমূলক আচরণ এবং ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ এই পদ্ধতিকে কলুষিত করেছে।

পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিল করার সুপারিশ : কমিশন যা বলছে

পুলিশ সংস্কার কমিশন গত ১৯ নভেম্বর এক সুপারিশে জানিয়েছে, চাকরি ও পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা যাচাই বন্ধ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন বলেছেন, ‘ভেরিফিকেশনের নামে হয়রানি ও দুর্নীতি বন্ধ হওয়া জরুরি। প্রার্থীর বা তার পরিবারের রাজনৈতিক পরিচিতি বিচার করা অযৌক্তিক।’

সবশেষ ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন পুলিশের ভেরিফিকেশন পদ্ধতি পুরোপুরি তুলে দেওয়ার সুপারিশের কথা জানিয়েছে।

কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী বলেছেন, ‘আমরা সুপারিশ করেছি, চাকরি কিংবা অন্য সেবার ক্ষেত্রে পুলিশের ভেরিফিকেশন আর বাধ্যতামূলক থাকছে না। এটি কোথাও আর থাকবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘নাগরিক হিসেবে পাসপোর্ট পাওয়া সবার অধিকার। উন্নত দেশে যেমন পাসপোর্ট সরাসরি আবেদনকারীর ঠিকানায় পৌঁছে যায়, এখানেও সেই পদ্ধতি চালু করতে হবে।’

পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রয়োজনীয়তা ও সমাধানের দিকনির্দেশনা

পুলিশ ভেরিফিকেশন পুরোপুরি তুলে দেওয়ার সুপারিশকে অযৌক্তিক বলে মত দিয়েছেন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুরুল হুদা। তার মতে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র প্রদানে প্রার্থীর পেছনের ইতিহাস জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি বলেন, ‘আপনি যাকে প্রজাতন্ত্রের চাকরি দেবেন বা পাসপোর্ট দেবেন, তার ব্যাকগ্রাউন্ড জানা ভীষণ জরুরি। ভেরিফিকেশনের প্রয়োজন অবশ্যই আছে। এটি তুলে দেওয়ার প্রস্তাব কোনো সঠিক চিন্তাপ্রসূত বলে মনে করি না। কারণ অধিকার ভালো হওয়া স্বাপেক্ষে পাওয়া উচিত।’

তবে ভেরিফিকেশনের নামে হয়রানি, দুর্নীতি এবং প্রক্রিয়ার ধীরগতির সমাধান নিয়ে ভাবার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘এখানে দুর্নীতি ঢুকে গেছে, হয়রানি হচ্ছে, প্রক্রিয়া ধীর হয়ে গেছে। এটি সিস্টেমের সমস্যা নয়, বরং প্রশাসন ও রাজনৈতিক পর্যায়ের দুর্বলতা। মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলা সমাধান নয়।’

নুরুল হুদা মনে করেন, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ভেরিফিকেশন সম্পন্ন করা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গেলে হয়রানি অনেকটাই কমে আসবে।

পুলিশ ভেরিফিকেশন তৈরি হয়েছে হয়রানি করার জন্য

পুলিশ ভেরিফিকেশন পদ্ধতি বর্তমানে হয়রানি ও দুর্নীতির প্রতীক হয়ে উঠেছে, এমন মন্তব্য করেছেন সাবেক সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান। তার মতে, এই পদ্ধতি বন্ধ করার সুপারিশ যথাযথ এবং সময়োপযোগী।

তিনি বলেন, ‘পুলিশ ভেরিফিকেশন উপনিবেশ আমলে তৈরি হয়েছিল মানুষকে হয়রানি করার জন্য। বর্তমানে বাংলাদেশে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেভাবে দুর্নীতি ও বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়, তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। বাপ-দাদার রাজনৈতিক পরিচয়কে বিচার করার বিষয়টি অন্যায়।’

তার মতে, ভেরিফিকেশনের নামে দুর্নীতি ও পক্ষপাতমূলক আচরণ মানুষের ন্যায্য অধিকার ক্ষুণ্ন করছে, যা অবশ্যই বন্ধ করা উচিত।

পুলিশ ভেরিফিকেশনের বিকল্প উপায়

পুলিশ ভেরিফিকেশনের বিকল্প ব্যবস্থা চালু করা নিয়ে বিশ্লেষকরা বিভিন্ন মত দিয়েছেন। তারা মনে করেন, আবেদনকারীর দেওয়া তথ্য যাচাই করা প্রয়োজন। বিশেষ করে কোনো ব্যক্তির নামে ফৌজদারি মামলা আছে কি না বা তার আচরণ কেমন, তা যাচাইয়ের জন্য প্রযুক্তি নির্ভর প্রক্রিয়া চালু করা যেতে পারে, যা হয়রানি ও দুর্নীতির পথ বন্ধ করবে।

বিকল্প উপায় হিসেবে স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার বা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছ থেকে চরিত্র সনদ সংগ্রহের পরামর্শ দিয়েছেন অনেকে। তবে এই সনদ সংগ্রহেও ঘুষ বা পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ রয়েছে, যা দূর করতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছেন।

“পুলিশের ডাটাবেসে নাগরিকদের অপরাধ ও মামলার তথ্য নথিভুক্ত থাকলে সহজেই আবেদনকারীর তথ্য যাচাই করা সম্ভব। এতে কোনো ধরনের হয়রানির সুযোগ থাকবে না।” এছাড়া, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ডাটাবেস ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডাটাবেসের মাধ্যমে পরিচয় ও শিক্ষাগত যোগ্যতা যাচাই করা যেতে পারে। তবে এই ডিজিটাল ডাটাবেস ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী, নির্ভুল, এবং নিরাপদ করার প্রয়োজন রয়েছে।

পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রধান অতিরিক্ত আইজি মো. গোলাম রসুল জানান, “বাংলাদেশে পুলিশ ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে স্বচ্ছতা নিশ্চিতের কাজ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভালোভাবেই হয়েছে। বাইরের দেশে সাধারণত একটি কনফার্মিং ক্লজ ব্যবহার করা হয়, যেখানে আবেদনকারী নিজেই তার অপরাধ সংশ্লিষ্টতার তথ্য জানায়। মিথ্যা তথ্য প্রমাণিত হলে তার আবেদন বাতিল হয়।”

পুলিশ ভেরিফিকেশন পদ্ধতির ভবিষ্যৎ এবং আমার মতামত

পুলিশ ভেরিফিকেশন পদ্ধতি নাগরিক তথ্য যাচাইয়ের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হলেও এটি দুর্নীতি, হয়রানি এবং ধীরগতির প্রতীক হয়ে উঠেছে। ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়ায় আবেদনকারীর তথ্য যাচাই করা প্রয়োজন হলেও এর বর্তমান রূপে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
এই পদ্ধতি সংস্কার করে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর সমাধান আনা প্রয়োজন। জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ডাটাবেস, পুলিশ ডাটাবেস এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডাটাবেস ব্যবহার করে প্রার্থীর তথ্য সঠিকভাবে যাচাই করা সম্ভব।


এছাড়া, আন্তর্জাতিক মানের কনফার্মিং ক্লজ চালু করে আবেদনকারীর তথ্য সরাসরি যাচাইয়ের পাশাপাশি সিস্টেমকে আরও স্বচ্ছ এবং উন্নত করা যেতে পারে। বিকল্প পদ্ধতিগুলো কার্যকর হলে হয়রানি এবং দুর্নীতির অভিযোগ অনেকটাই দূর হবে এবং প্রক্রিয়া আরও কার্যকর হবে বলে আশা করি।
আর এই সংস্কারগুলোর মাধ্যমে পুলিশ ভেরিফিকেশন পদ্ধতি সবার জন্য সহজ, দ্রুত এবং স্বচ্ছ করতে হলে প্রশাসনের আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন জরুরি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top